Monday, April 13, 2020

"ভয়ংকর সন্ধ্যা" পর্বঃ ৩



বাবলুদের বাসায় পরিক্ষা উপলক্ষ্যে মিলাদ পড়ানো হচ্ছিল। মসজিদের ইমাম সাহেব আর কিছু মুসল্লি ছাড়াও বাড়ির মুরুব্বিরা ও এতে ছিলো।  আনুমানিক ২ টার দিকে সবার খাওয়া দাওয়া শেষে রাতুল, আনিকা আর বাবলু অটো রিক্সায় তাদের জিনিসপত্র উঠাচ্ছিল, শায়লা বেগম বাসার গেট পর্যন্ত এসে বার বার বাবলুর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করতে লাগলো।  ভালো করে পরিক্ষা দিবি, কারো দিকে তাকাবি না, প্রশ্ন একবারের জায়গায় দশ বার পড়বি ইত্যাদি নানা নির্দেশনা দিয়ে শেষ বার বাবলু কে দোয়া করে বিদায় দিলো। বাবলুর মনে হলো সে কোন পরিক্ষা দিতে যাচ্ছে না, যুদ্ধে যাচ্ছে, সবার এতো সিরিয়াস মনোভাব দেখে মনে মনে অবাক ই হলো। 


আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে তাদের গাড়ি এগিয়ে চলছে।আনিকা গাড়ির ভিতর কখনোই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। সেটা বাস হলে ত একেবারে ই নয়, অটো রিক্সা তেও ওর সমস্যা। সারা রাস্তা সে ক্ষনে ক্ষনে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কখন শেষ হবে রাস্তা, কখন
পৌঁছাতে পারবে..... 
অন্যদিনের তুলনায় আজকে ওদের পৌঁছাতে অনেক দেরি হলো কারন রাস্তায় গাড়ির বেশি ভির ছিল। ওদের গাড়ি যখন রূপসদী গ্রামে প্রবেশ করেছে তখন বিকেল প্রায় ৫ টা বেজে গেছে, সারা গ্রামে  একটা খুশির আমেজ বিরাজ করছিল, পরিক্ষার্থী দিয়ে পুরো গ্রামের বাড়িগুলো ভরে গেছে, এ যেনো অন্য রকম এক আনন্দময় পরিবেশ!! 

আনিকার ঘরে ঢুকে ব্যাগ পত্র রেখেই শুয়ে পড়ল,  কারন গাড়ির ধকল সে সামলাতে পারে না। অনেক ক্লান্ত হয়ে গেছে। রাতুল ব্যাগ থেকে কাপড় বের করে গোসল করার জন্যে বের হয়ে ফিরে এলো। গোসল খানায় পপি গোসল করছে। বাবলু পড়ার টেবিল টা ভালো করে গুছিয়ে বই নিয়ে পড়তে বসে গেলো..........
রাতুল এই গ্রামের অনেক কে ই ভালো করে চিনে কারন সে এই গ্রামে থেকেই পরীক্ষা দিয়েছিল। সন্ধ্যার দিকে সে বেরিয়ে গেলো স্থানীয় কিছু বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে। 

সন্ধ্যার পর পর ই পুরো গ্রাম থমথমে হয়ে যায়। নেহাৎ ঠেকায় না পড়লে খুব বেশি মানুষ জন বের হয় না। দোকান পাটের মৃদু আলো ছাড়া আর তেমন কিছু তখন চোখে পড়েনা কিন্তু কানে বাজে দূর কোথাও থেকে  ভেসে আসা শিয়ালের হুক্কাহুয়া ডাক আর ঝিঝি পোকার শব্দ........
রাতুল, আবির, পলাশ সহ আরো ৩/৪ জন মাঠের নিচের বটগাছটার নিচে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। রাতুল কথা প্রসঙ্গে আবির কে জিজ্ঞেস করলঃ 

"আচ্ছা আবির,  শুনলাম তোদের গ্রামে নাকি ভূতপ্রেত আছে? সত্যি নাকি কথাটা"?

আবির কিছু বলার আগেই পলাশ বললঃ দোস্ত তুমি সত্যি ই শুনছো! আমাদের গ্রামের ইতিহাস ত তোমরা জানোই। বাপ দাদার আমলের জমিদার আর লাঠিয়াল রা যে অত্যাচার করে গেছে তাদের সেই অভিশাপ ই সারা গ্রাম বহন করছে। এই তো সামনেই একটা বিশাল বড় জমিদার বাড়ি আর একটা লাঠিয়াল বাড়ি আছে! সন্ধ্যার পরে ওই দিক টায় কোন মানুষ জন যায় না কারন যারা ই আজ পর্যন্ত গেছে সবাই বলছে সেখানে খারাপ আত্মা রা ঘোরাঘুরি করে, কাউকে কাউকে ত দিন দুপুরেও অনেক ক্ষতি করেছে!

রাতুল হেসে বললঃ বন্ধু আমার ত এ সব হান্টেড প্লেস অনেক ভালো লাগে। চলোনা একদিন সবাই মিলে সেখানে গিয়ে বসে আড্ডা দিবো!

আবির ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললঃ তুই জানোস ওইখানে চিতাখোলা আছে? দিনে যাইতেই ভয় লাগে, আবার তুই বলস সন্ধ্যার পর যাইতে! বাপ দাদার দেওয়া জান টার প্রতি তর মায়া না থাকতে পারে, আমাদের মায়া আছে! 

আবিরের কথায় রাতুল ছাড়া বাকি সবাই সম্মতি দিলো। ওদের আড্ডা টা প্রায় শেষ হয়েই আসছিল এমন সময় কারেন্ট চলে গেলো!  কারেন্ট চলে যেতেই মূহুর্তের ভিতর পুরো গ্রাম কেমন যেনো থমথমে হয়ে উঠল!  পিনপন নিরবতা বিরাজ করছিল চারপাশে! হঠাৎ খুব দূর থেকে কোন একজন লোক কে দৌড়ে আসতে দেখে রাতুল,আবির সহ সবাই নড়েচড়ে বসল! লোকটা পাগলের মতো দৌড়াচ্ছিল তাই রাতুল অনেকটা আগ্রহ নিয়েই জিজ্ঞেস করলঃ 
"চাচা, এভাবে অন্ধকারে দৌড়ে কোথায় যাচ্ছেন! কি হয়েছে?

লোকটা দৌড়ের মাঝে থেকেই বললঃ লাইঠঠাল বাড়িতে কারে জানি বেল গাছে ঝুলাইয়া রাখছে! বেবাগ লোকেরা হেইদিকেই যাইতাছে, তোমরা গেলে আহো! 

লোকটা কারো জন্যে অপেক্ষা করলো না। যেভাবে দৌড়ে এসেছিল সেই গতিতেই চলে গেলো।  রাতুল আবির কে অনেক বার যাওয়ার জন্যে বলার পর সবার অনিচ্ছা থাকা স্বত্তেও আবিরসহ সবাই যেতে রাজি হলো। রাতুল মনে মনে অনেক উত্তেজনা অনুভব করছিল! অনেক দিন পর স্বচোক্ষে কোন ভূতে ধরা মানুষ দেখতে পাবে ভেবেই রোমাঞ্চকর অনুভূতি কাজ করতে লাগলো কিন্তু বাকিদের চেহারা দেখে মনে হচ্ছিল যেনো সবাইকে কোন যুদ্ধে পাঠানো হচ্ছে যেখান থেকে ওদের ফিরার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে!!

১০/১৫ মিনিট হাঁটার পর ওরা গ্রামের দক্ষিন দিকে একটা পুরাতন হিন্দু বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো। এখানে আসার আগে সবার ভিতরেই একটা ভয় কাজ করছিল কিন্তু আসার পর যখন দেখলো কম পক্ষে ১০০/১৫০ জন লোক জমে গেছে ইতিমধ্যেই, তাই সবাই মনে ভরসা পেলো। রাতুল, আবির, পলাশ সহ বাকিরা ভির ঠেলে একটু সামনে যেতেই দেখলো সত্যি সত্যি একটা ১০/১২ বছরের মেয়েকে বেল গাছের মাথায় কে যেনো বসিয়ে রেখেছে!! মেয়েটার চুলগুলো খোলা, এলোমেলো হয়ে আছে,বুকে উড়না নেই, অন্ধকারে ও বেশ ওর বিশ্রি হাসিটা সবার কানে বাজছিল!!

মধ্য বয়সের কোন একজন মেয়েটাকে গাছ থেকে নামাতে গাছে উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু মেয়ে ভয়ংকর গলায় চেঁচিয়ে উঠে বললঃ খবরদার!! কেউ যদি গাছে উঠস তাইলে আমি গাছ থেকে লাফ দিয়া আত্মহত্যা করমু!!
লোকটা গাছে উঠতে যাবে কিনা অন্যদের সম্মুতির জন্যে যখন সবার দিকে তাকালো, দাঁত ছাড়া ৬৫/৭০ বছরের এক বৃদ্ধ ভাংগা ভাংগা কন্ঠে বললঃ 
"আরে মিয়া দেখো কি! গাছে উঠো!নামাইয়া আনো কমলারে"! ওরে প্রেতনী ধরছে, হরিবলরে দিয়া ঝাড়াইতে হইবো!


ভিড়ের মাঝখান থেকে লম্বা চুলওলা মধ্যবয়সী এক লোক দাঁড়িয়ে বললঃ কাদেরে বাপ, ভয় পাও কেন, গাছে উঠো, আমি প্রেতাত্মা তাড়ানোর মন্ত্র জপতাছি, তুমি শুধু মাইয়াডারে গাছ থেকে নামাইয়া আনো! 
কাদের বাপ খ্যাত লোকটি পুনরায় গাছে উঠে এক রকম জোড় করেই মেয়েটাকে গাছ থেকে নামিয়ে আনলো। সবাই অনেক আগ্রহ নিয়ে ঝুকে মেয়েটাকে দেখছিল, অন্ধকারের মধ্যে তেমন কিছু দেখা যাচ্ছিল না, দু এক জন লোক হাতের টর্চ জ্বেলে রেখেছিল। মেয়েটা চুপ হয়ে বসে নিজ মনে কি যেন বিড়বিড় করছি........হরিবল হাতে থাকা শংখটা তে কিছু একটা পড়ে ফুঁ দিয়ে মেয়েটার মাথায় রাখার সাথে সাথেই মেয়েটা তীব্র চিতকার করে উঠলো!!  ওর কন্ঠটা অনেক ভয়ানক শোনাচ্ছিল! উপস্থিত সকলেই ভয়ে কয়েক পা পিছিয়ে গেলো কিন্তু হরিবল আগের মতোই নির্বিকার ভাবে মন্ত্র জপ করতে করতে মেয়েটাকে ঝাড় ফুঁ দিতে লাগলো। মেয়ের চিতকার ক্রমশ বাড়ছিল......এভাবে হরিবল যখন ক্রমাগত মন্ত্র জপ করছিল মেয়েটা কিছু একটা ছুড়ে মারল হরির গায়ে!! হরিবল জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো!!  ঘটনাটি এতোই দ্রুত ঘটলো যে উপস্থিত সকলেই হতবাক হয়ে গেলো!  মেয়েটা লাফিয়ে উঠে চোখ পাকিয়ে জোড়ে চিতকার করে বলে উঠলঃ

 "আমি কাউকে ছাড়বো না! সব কয় টাকে আজ শেষ করে দিবো"! 
মেয়েটা মাথা ডানে বায়ে পাগলের মতো ঘোরাতে শুরু করল যা দেখে সবাই ভয়ে জ্ঞান হারানোর অবস্থা! সবাই দৌড়ে পালাতে লাগলো!! রাতুলের দিকে কটমট চোখে তাকিয়ে পলাশ বললঃ তুই আজ আমাদের কে মারার জন্যে এখানে আনছিস!! পালা জান থাকতে!! তোর কথায় আর কখনো আমি কোথাও যাবো না!
রাতুল ও ওদের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে বললঃ আরে মজা ই ত লাগছিল! তোরা দৌড় না দিলে ত আমি সব টা দেখে আসতাম! 
আবির ভয়ানক হাসি দিয়ে বললঃ দোস্ত আর এক মিনিট ওই জায়গায় দাঁড়ালে আমাদের জান আর দেহে থাকতো না! তুই বেটা মানুষ না নাকি! ভয় ডর তর নাই! 

রাতুল ও মনে মনে বেশ ভয় পেয়েছিল কিন্তু মুখে প্রকাশ না করে আগের মতোই হেসে বললঃ এটাই ত আসল সাসপেন্স!! যা তোরা বুঝবি না কখনো!!




No comments:

Post a Comment