"আমি নিজেই ছিলাম এই ঘটনায়"!! তুই ত শুধু শুনেছিস আর আমি পুরো ঘটনা লাইভ দেখেছি!!
রাতুলের কথায় আনিকা আর বাবলু চোখ গোল করে হা করে তাকিয়ে রইল। বাবলুর একবার মনে হলো রাতুল ওদের কে ভয় দেখানোর জন্যে এসব কিছু বলছে কিন্তু একটু পর ই ওর ভুল ভেংগে গেলো কেননা ইতিমধ্যেই রাতের ব্যাপারটা পুরো গ্রামেই ডাক পড়ে গেছে যার প্রভাব টা এই বাড়িতেও পড়েছে!
পপি মেয়েটা আনিকাকে ডেকে নিয়ে আরো কয়েক জন মেয়ের সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিল এমন সময় ওর দাদী ই আগে কথাটা সবার সামনে তুলল। বৃদ্ধা মহিলার বয়স হয়েছে অনেক কিন্তু মুখের একটা দাঁত ও পড়ে নি। তিনি পান মুখে দিয়ে গম্ভীরমুখে সবার দিকে তাকিয়ে বললঃ
"এই পপি! তোরা কেউ সন্ধ্যার পর কাজ ছাড়া ঘর থেকে এক পাও বের করবি না! গতকাল রাতে তোর বাচ্চু চাচার মেয়েরে খাটাস এ ধইরা মাইরা ফেলতে চাইছিল! কোন রকমে ওরে গ্রামের মানুষ বাঁচাইয়া আনছে"!
আনিকা উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করলঃ কি হয়েছিল দাদী? আমার ভাইয়াও আজকে ঘটনা টা বলেছে কিন্তু আমরা কেউ বিশ্বাস করি নি, ভেবেছি হয়ত আমাদের কে ভয় দেখাচ্ছে!!
মহিলা আরো গম্ভীর হয়ে বললঃ তোমরা ত জানো না, আমাদের এ গায়ে বহু আত্মা, প্রেতাত্মা, রাক্ষাস আছে! দিন দুপুরেই হেরা যারে তারে মাইরা গাছে ঝুলাইয়া রাখে! গত রাতে ত এই গ্রামের সেরা তান্ত্রিক হরিবল রে অজ্ঞান ই কইরা ফালাইয়া রাখছিল প্রেত্নীরা!! ভাগ্য ভালো যে অনেক মানুষ আছিল আর ঠিক সময় বাঁচাইতে পারছে!! সাবধান থাকো সবাই!! দিন কাল খারাপ!!
মহিলার কথা শুনে আনিকার কিছুটা ভয় লাগলো, পপি মেয়েটা আনিকার মুখের দিকে তাকিয়ে বললঃ আমাদের বাসা থেকে সোজা যেই বাড়িটা দেখা যায় বট গাছের পিছনে, ওইটা চেয়ারম্যান বাড়ি। ওই বাড়িতেও ভূত আছে! চেয়ার ম্যানের ছোট পোলা, ফাঁসি দিয়ে মারা গেছিল! গ্রামে হের আত্মা ঘুরে বেড়ায়, অনেকে ই দেখছে রাত দুপুরে!!
আনিকা এবার ঢোক গিলে চোখ গোল করে সবার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল ফেলফেল করে! সে মনে মনে বললঃ এ কোন ভূতুড়ে গ্রামে এসে পড়েছি!! সব কিছুই ভৌতিক লাগছে এখন!!
রাতুল বিকেলে যখন বাবলুর কাছে রাতের সেই অভিজ্ঞতার কথা বর্ণনা করছিল তখন আনিকাও যোগ দিলো। তাদের কথার মাঝে সেখানে পপি, কান্তা আর কয়েকজন যুক্ত হলো। সবাই মনোযোগ দিয়ে রাতুলের কথা শুনছিল। কথার ফাঁকে ফাঁকে সুকৌশলে পপি বাবলু কে একটা চিঠি ধরিয়ে দিলো! বাবলু ভেতরে ভেতরে অনেক excited হয়ে পড়েছিল, প্রেমের আভাস পাচ্ছিল সে। তাই সবাই যখন কথার মাঝে ব্যস্ত তখন সে আড়ালে গিয়ে চিঠিটা খুলে দেখলো কি লিখা আছে.......কিন্তু চিঠিতে কিছু লিখা নেই!! সাদা পেজ! বাবলু বিরক্তি নিয়ে কাগজটা ফেলে দিলো! তারপর আবার আগের জায়গায় এসে সবার সাথে আলোচনায় যোগ দিলো। রাতুল তার অভিজ্ঞতার সাথে আরো রসিকতা মিলিয়ে এমন ভাবে ঘটনা টা উপস্থাপনা করতে লাগলো যে উপস্থিত সবাই ভীমড়ি খেয়ে গেলো!
দেখতে দেখতে এ গ্রামে প্রায় রাতুল দের ১৫ দিন কেটে গেছে যার মাঝে গ্রামের অনেকের সাথেই তাদের খুব ভালো সম্পর্ক হয়ে গেছিল। এর ফলে প্রতিদিন বিকেলে বিভিন্ন বাসার পরিক্ষার্থী রাও আড্ডা দেওয়ার জন্যে রাতুলদের সাথে এসে যোগ দিতো। সামনে গণিত পরিক্ষা তাই ৩ দিন গ্যাপ দেওয়া হয়েছে পরিক্ষার মাঝে। এর ফলে অনেকে ই অবসর সময় টা উপভোগ করার জন্যে রাতুলদের সাথে যুক্ত হলো। বাবলুদের গ্রাম থেকে ওর যে সব সহপাঠী পরিক্ষা দিতে এসেছে তাদের অনেক অনুরোধের পর রাতুল রাজি হলো আজকে সবাই মিলে গ্রামের মাঝখানে যে বিশাল বড় জমিদার বাড়ি টা আছে সেখানে ঘুরতে যাবে। ওদের সাথে আনিকা,পপি কান্তা ও যুক্ত হলো।
রাতুল অনেক রসিক মানুষ। ওর কথা সবার ভালো লাগে তাই ও যখন কোন মিথ্যা কথা সবার সামনে সত্য বলে চালিয়ে যায়, তখন কেউ এ নিয়ে দ্বিমত পোষণ করে না। রাতুল আবির কে সাথে নিয়ে নিলো।
ওরা সবাই যখন বের হলো তখন বিকেল ৫ টার মতো বাজে। আকাশ পরিস্কার ই ছিল কিন্তু জমিদার বাড়ির পাশে পৌঁছাতে পৌঁছাতে আকাশটা মেঘলা হয়ে গেছে। প্রায় কুড়ি মিনিট হাঁটার পর ওরা যখন প্রাচীন সেই জমিদার বাড়ির সামনে এসে পৌঁছাল তখন পুরো আকাশ কালো হয়ে গেছে মেঘে!! পরিবেশটা কেমন যেন থমথমে হয়ে গেছে! আকাশের এমন অবস্থা দেখে সবাই মন খারাপ করে ফেললেও রাতুল হেসে বললঃ
"এটাই তো সুন্দর পরিবেশ "!! বৃষ্টি বৃষ্টি ভাব থাকবে, ঝড়ো বাতাস থাকবে! এসব না থাকলে হান্টেড প্লেস এ এসে কি কোন মজা আছে! তোমরাই বলো!
সবাই রাতুলের কথায় ইতিবাচক সাড়া দিলো। আবির গ্রামের স্থানীয় ছেলে। সে একে একে সবাই কে জমিদার বাড়ির সব ঐতিহ্য ব্যাখ্যা করতে লাগলো। ওরা সবাই জমিদার বাড়ির সামনে বিশাল মাঠ টায় এসে বসল। সবার ভিতরেই এক অন্য রকম ভালো লাগা কাজ করছিল। আবির যখন জমিদার বাড়ির ঘটনা বলতে ব্যস্ত তখন কথার ছলে আনিকা হঠাৎ আবির কে উদ্দেশ্য করে বললঃ " ভাইয়া, মনে কিছু না করলে আপনি যদি আমাদের কে একটু বলতেন..... আপনার চেহারা এসিডে কি করে ঝলসে গেছে?
আনিকার প্রশ্নে আবির কথার মাঝে হঠাৎ চুপ হয়ে গেলো। রাতুল ব্যাপার টা খেয়াল করে সাথে সাথেই আনিকা ধমক দিয়ে বললঃ "পাগলের মতো কথা বলস কেন! ঘুরতে আসছিস, ঘুর, এতো বাড়তি কথা বলতে কে বলছে তোকে?
রাতুলের কথার পাত্তা না দিয়ে অন্য সবাইও আনিকা কে সমর্থন করল। রাতুল সবাইকে ই বিষয়টি নিয়ে কথা না বলার অনুরোধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু ওর কথা মাঝ পথে থামিয়ে দিয়ে আবির কিছুক্ষন চুপ করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল..... তারপর বড় একটা নিশ্বাস ছেড়ে বলতে শুরু করলঃ
" আমার এ অবস্থা আসলে অনেকটা আমার খালামনির জন্যেই হয়েছে! আমাদের দু টা বাড়ি পরেই একটা বাসা আছে। ওই বাড়ির বড় ছেলেটা আমার খালামনিকে ভালো বাসতো কিন্তু খালামনি পাত্তা দিতো না!....
আবির কিছুক্ষন আবার চুপ করে রইল। ওর সিরিয়াস মুড দেখে সবাই চুপ হয়ে গেলো। কিছুক্ষন চুপ থাকার পর আবির আবার বলতে লাগলো.......
"খালামনি প্রতিদিন যে ঘরে থাকতো সে ঘরে আমি বেশি একটা যেতাম না, কিন্তু ওই রাতে আমাদের ঘরে মেহমান ছিল অনেক তাই আমি আর আমার ছোট বোন খালামনির রুমে ছিলাম। আমি খালা মনির জায়গায় ঘুমিয়ে ছিলাম, উনি আমার বোনার সাথে নিচে শুয়ে ছিল হঠাৎ মাঝ রাতে সেই পাশের বাসার ছেলেটা জানালা দিয়ে খালামনিকে ভেবে আমার গায়ে এসিড ঢেলে পালিয়ে যায়! আমার গায়ে এসিড পড়েছে, খালার গায়েও পড়েছে কিছুটা!!!
সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেছে। আনিকা আবার জিজ্ঞেস করলঃ যে এসিড মেরেছে তাকে ধরতে পারছিলেন পরে?
আবির মাথা নেড়ে বললঃ না! সে সেদিন থেকেই গ্রাম থেকে পালিয়েছে!!
এ ঘটনা শুনে কেউ আর কোন কথা বলল না।রাতুল সবার সিরিয়াস মুড ঠিক করার জন্যে হেসে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল কিন্তু আকাশে খুব ঘন ঘন বিজলি চমকাতে দেখে সবাই বাসায় ফিরতে ব্যস্ত হতে উঠলো। এর মাঝে সেখানে ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনা ঘটে গেলো.......
আবির যখন নিজের কথাগুলো বলছিল তখন ওদের কথার মাঝে পপি মেয়েটা হাঁটতে হাঁটতে জমিদার বাড়ির চিলে কোঠার দিকে চলে গেছিল। কেউ খেয়াল করে নি। হঠাৎ ওর চিতকার শুনে সবাই তড়িঘড়ি করে ওকে খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো! কোথাও দেখা যাচ্ছে না ওকে কিন্তু ওর চিতকার শুনা যাচ্ছে বারবার!!
অনেক্ষন পর পাভেল নামে বাবলুর বন্ধু টা চিলে কোঠার জানালায় পপিকে দেখে, সবাই কে ডাক দিয়ে আংগুল দিয়ে দেখাতে লাগল!! সবাই পাভেলের হাতের দিকে নজর দিয়ে যখন উপরে তাকালো, সবার চোখ ছানাবড়া হয়ে গেছে!!!
পপির অর্ধেক শরির জানালার বাহিরে আর অর্ধেক শরির জানালার ভিতরে ছিল! পপি অজ্ঞান হয়ে জানালার মাঝখানে পড়ে আছে, চুল দিয়ে ওর পুরো মুখ ঢেকে গেছে,হাত দুটি ছড়িয়ে দুপাশে পড়ে আছে!!!
এ দৃশ্য দেখে সবাই 'থ' হয়ে গেলো, সবাই যেনো নড়ার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে!!!
No comments:
Post a Comment