Monday, March 16, 2020

"সেই তুমি " পর্বঃ ৯



জল খাটের এক পাশে শুয়ে শুয়ে অন্তুর কথা ভাবছিল। ওর এখন নিজেকে অনেক অপরাধী মনে হচ্ছে কারন অন্তু কে যদিও সে তখন মন থেকে ভালোবাসে নি কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সে অনেক বড় ভুল করেছে!  অন্তু কে অপমান করার পর থেকে জল এক মূহুর্তের জন্যেও অন্তুর কথা ভুলতে পারছে না। 
নাহ! অনেক হয়েছে, আজকে আর থাকতে পারছিনা! নিজেকে নিজেই বলল.....এবার যে করেই হোক ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে! ইস কতোদিন হয়ে গেছে! হয়তোবা পাগল টা আমার জন্যে কান্না করছে! জল বিছানা থেকে লাফিয়ে উঠে মায়ের মোবাইলটা খুঁজতে লাগলো। বাহিরে উঁকি দিয়ে দেখলো হেনা বেগম উঠানে এক দল মহিলা নিয়ে গল্প করছে। 

জলঃ এই যোগাযোগ টা ই কাজে লাগাতে হবে। কোথায় রাখছে মোবাইলটা!  অসহ্য লাগতাছে! এই তো পেয়েছি!! 

মোবাইলটা আলমারিতে রাখা ছিল, খুঁজে পাওয়ার পর মনে হলো হাত পা কাঁপছে!  কি বলবে ও অন্তু কে! অজান্তেই দাঁত দিয়ে নখ কাটতে লাগলো.......

নাহ! কিছু বলবো না, শুধু ওর কন্ঠ টা শুনবো! আজকে আব্বু আসার পর যে করেই হোক কান্নাকাটির নাটক করে হলেও কালকেই ঢাকা যাবো.......আমি ওকে সত্যি ভালো বেসে ফেলেছি! আর দেরি হলে আমি মরেই যাবো! আল্লাহ একটু সাহায্য কইরো প্লিজ! নিজে নিজেই কথাগুলো বলে উপরের দিকে দুহাত জোড় করে একটা চোখ টিপ দিলো সে! 
মোবাইলটা হাতে নিয়ে গলাটা একটু পরিস্কার করে নিয়ে অন্তুর নাম্বার টা ডায়েল করল। রিং হচ্ছে!!! মনটা ভিষণ ছটফট করতে লাগলো!  মনে মনে দোয়া করতে লাগলো....

 প্লিজ কলটা ধরো.........প্লিজ? 
একবার..... দুবার এভাবে ২৪ টা কল দিলো জল অন্তুর নাম্বারে কিন্তু কল রিসিভ করছেনা কেউ! জলের মুখ টা লাল হয়ে উঠল রাগে! দাঁত চেপে নিজেকে নিজে ই বললঃ কল ধরবে কেন! ওয় ত রং তামাশা নিয়ে অনেক ব্যস্ত! রং তামাশা বের করতাছি! 
জল জান্নাতের নাম্বারে কল দিলো।  একবার দুবার রিং হওয়ার পর ওপাশ থেকে জান্নাত রিসিভ করল।
জান্নাত ঃ হ্যালো!  কে, জল?

জলঃ হুম, কেমন আছিস?

জান্নাতঃ ভালো না রে, মন খারাপ। 

জলঃ কেন, কি হয়েছে? 

জান্নাত ঃ হয়েছে একটা কিছু, তুই আসলে বলল। এখন স্যারের বাসায় যাবো পড়তে। তুই আর পড়বি না?

জলঃ পড়বো না মানে!! আমি কালকেই আসতাছি। ওই শোন না....তুই কি এটা বলতে পারবি,  ও কি আমার উপর রাগ করে আছে? আমাকে মনে করে?

জান্নাত জলের কথা টা বুঝেও না বুঝার ভান করে এড়িয়ে যেতে চাইলো। সে বললঃ 
আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে, রাখিরে দোস্ত!

জলঃ এই! শোন..... প্লিজ? 

জান্নাতঃ বল। 

জলঃ আরে ওর জন্যে অনেক খারাপ লাগছে রে.....আমি ওকে ২৪ টা জল দিয়েছি, ও একবার ও ধরেনি, হয়তোবা নাম্বার চিনে না,কিন্তু একটা মিস কল অন্তত দিতে পারতো! তুই গিয়ে ওকে একটু বলিস, প্লিজ একটা মিস কল দিতে? আমি আজকে ওর কন্ঠ না শুনলে হয়তো পাগল হয়ে যাবো!

জলের কতগুলো শুনে জান্নাত মনে মনে রেগে উঠল কিন্তু কন্ঠটা স্বাভাবিক রেখেই বললঃ আচ্ছা বলবো, রাখি। 
জান্নাত কল টা কেটে দিলো। সে বুঝতে পেরেছে জল আবার ফিরে আসবে অন্তুর জিবনে, কিন্তু এটা হতে দিবো না আমি, মনে মনে ফিসফিস করে কথাগুলো বলার পর ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলো অন্তুর বাসার উদ্দেশ্যে।


****চোখ গোল করে হা করে আবুল বসে আছে। সাজু বললঃ স্যার, আজকে কেউ যদি না আসে?  
অন্তুঃ আসবে, আর ওরা ত কেউ জানে না তোমরা বিচার চাইতে এখানে বসে আছো! 
আহমেদ মুচকি হাসি দিয়ে বললঃ স্যার, বিচার কিন্তু সিরিয়াস করতে হবে! 

অন্তু মাথা নাড়ল। 
তানহা ভিতর থেকে ডাকতে লাগলো। অন্তু খেয়াল করে নি। 
আবুল বিনয়ী হয়ে বললঃ আপু স্যার ব্যস্ত! 

তানহা ভেতর থেকে মোবাইলটা এনে দিয়ে বলল সেই কখন থেকে ফোন টা বাজছে, শুনতে পাও নাই? তোমার জিবনে কি কোন দিন ই একবার কল দেওয়া কোন লোকের কল ধরতে পারবা না? কোন দিন দেখলাম না কারো কল সাথে সাথে ধরতে পারছ! ২৪ টা কল আসছে কোন একটা নাম্বার থেকে! 

তানহার কথার কোন জবাব দিলো না অন্তু, শুধু হাসলো কারন অভিযোগ টা মিথ্যে নয়। অন্তু কখনও কারো কল ধরতে পারে না, ও মোবাইল ইউজ করে ঠিকি কিন্তু কোন কলের সময় ই ওর হাতে মোবাইলটা থাকে না, আর যদিও বা থাকে ওর তাড়াহুড়োর কারনে কল রিসিভ হওয়ার পরিবর্তে কেটে যায়!! 
  
দরজা লাগানো ছিলো কিন্তু কারো বুঝার বাকি রইলো না যে, মেয়েরা আসতাছে পড়তে কারন সিঁড়িঁ দিয়ে উঠার সময় ওরা এমন শব্দ করে উঠে মনে হয় সিঁড়িঁ ভেংগে ফেলবে! মেয়েদের কন্ঠ শুনে আবুল উৎসাহ নিয়ে বললঃ স্যার আসতাছে সব অপরাধী রা!  
আহমেদ মুখটা তে কৃত্রিম রাগ এনে বললঃ ওই সবাই গম্ভীর মুখ করে রাখ, যেনো ওরা বুঝে আমরা একদম সিরিয়াস! সাজু ও সায় দিলো। 

রুমের দরজা অন্তু খুলে দিলো। ভেতরে উকি দিয়ে যখন নন্দিনি দেখলো ছেলেরা যায় নি, ও অবাক হয়ে বললঃ স্যার, ছুটি দেন ওদের! আমরা অলরেডি ১০ মিনিট লেট করে আসছি! 

সাজু বললঃ দেখছেন স্যার, দেখছেন? না আসতেই কেমন শুরু টা করছে! 
অন্তু সবাইকে ভিতরে আসতে বলল। জান্নাত, নন্দিনি, আরশি, লিজা ভিতরের রুমে চলে যাচ্ছিল কিন্তু অন্তু ওদেরকে এই রুমেই বসতে বলে ওদের কে উদ্দেশ্য করে বললঃ  

তোমাদের মাঝে কে টেবিলে গরু নিয়ে এই অশুদ্ধ প্যারাগ্রাফ লিখেছ? 
মেয়েরা,একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল আর কেউ ই করেনি এমন একটা ভাব করল। 
আবুলঃ ওদের চেহারতে ই ভাসতাছে ওরা করছে!  স্যার, টাইট দেন! 

জান্নাত বললঃ ওই!  বেশি কথা বল কেন?
আমরা লিখছি তার কি প্রমাণ আছে? 

সাজুঃ চোর ত কাউকে বলে কিছু করে না? 

আহমেদ ঃ এটা তোমরা ছাড়া আর কেউ করে নি এটা আমি ডেম শিউর, বলে কপালটা কালো করার বৃথা চেষ্টা করল।

 জান্নাত ঃ স্যার, শোনেন, আমরা কেউ ই লিখি নি, আর এখানে কেউ যদি নিজেকে ডোমেস্টিক এনিমেল ভাবে আমাদের কি করার আছে! 

লিজাঃ স্যার, পোলারা এসব কি করে! ওরা নিজেরাই লিখছে আমাদেরকে বদনাম করার জন্যে! বিচার করেন ওদের! 
ছেলেরা সবাই এক সাথে বলে উঠলঃ বিচার আমরা ও চাই
পরিবেশটা আবারও খারাপ হয়ে যাচ্ছে তাই অন্তু বললঃ 
আজকের মতো যেহেতু কোন অপরাধী সনাক্ত হয়নি,  এটা বাদ, কিন্তু পরবর্তী তে যদি এমন হয় খারাপ হবে।  
 
অন্তু বুঝতে পেরেছে লিখা টা মেয়েরা ই লিখছে তাই ওদের দিকে তাকিয়ে বললঃ সবাই সবাইকে একটু শ্রদ্ধা করলেই মনে হয় তোমাদের সবার জন্যে ভালো হবে, তা না হলে নেক্স টাইম খারাপ হবে। 

বিচার টা মনের মতো হয়নি তবু স্যার আমরা আজকের মতো খুশি কিন্তু পরের বার কিন্তু খুশি হবোনা! আবুল হেসে বলল। 

ছেলেরা চলে যাওয়ার পর অন্তু জান্নাত কে বললঃ এটা তুমি লিখেছো, আমি শিউর ই জানতাম তবু বলি নি। পরের বার এমন করলে অনেক খারপ হবে! 

জান্নাতঃ জ্বি স্যার, আর হবে না। 
নন্দিনি জান্নাত কে ফিসফিস করে বললঃ ওই স্যার কে বল! জল যে স্যার কে মিসকল দিতে বলছে! 
জান্নাত বিরক্ত হয়ে বললঃ চুপ থাক! পারবো না!

**** জল মোবাইলটা হাতে নিয়ে বসে আছে
এটা ভেবে অন্তু হয়তো কল দিবে কিন্তু কোন কল এলো না.......রাগে ওর অনেক কান্না আসছিল। মোবাইলটা রেখে বালিশের নিচে মাথা দিয়ে কান্না করতে লাগল। মনে মনে বললঃ অবহেলা ই যদি করবে, কেন প্র‍্থম ভালোবেসে ছিল! আমি স্বিকার করি প্রথমে আমার ভুল ছিল কিন্তু এখন ত মন থেকেই ওর জন্যে ভালো বাসা আসছে! ও কেন বুঝতাছে না! জান্নাত, নন্দিনি দু জন কে ই ত কল দিয়ে বলেছি অন্তু যেন একটা মিস কল দেয়! ও তবু দিলো না!!! কাল ঢাকা যেতেই হবে........চোখ মুছে বকুল হোসেনের সামনে গিয়ে বললঃ 
আব্বু! আমার শনিবার এক্সাম আছে, নন্দিনি, জান্নাত ওরা কল করেছিল। আগামীকাল আমাদের নিয়ে যেও সাথে? 

 বকুল হোসেনঃ আগে বলিস নাই কেন তোর এক্সাম! এখন কালকে গিয়ে পড়ে পাস করবি কি করে?

হেনা বেগম ঃ তোমার মেয়ে যেই পড়াশোনা করে! সারাদিনেও ত বই নিয়ে বসতে দেখি না আমি! এইবার রেজাল্ট খারাপ হলে বিয়ে দিয়ে দিবো! 
মায়ের কথায় জল মুখ বাকা করে বকুল হোসেনের দিকে তাকিয়ে বললঃ আব্বু দেখছো! কি বলে এসব! 

বকুল হোসেন হেনা বেগমের দিকে তাকিয়ে চোখ গরম করে বললঃ খবরদার! আমার মেয়ে নিয়ে এখন ই এসব বলবা না! আমি আমার মেয়েকে অনেক বড় অফিসার বানাবো! আমি নিজে পড়াশোনা করিনাই তাতে কি! আমার মেয়ে অনেক বড় অফিসার হবে। যা মা, যা, তুই গিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে নে, আমরা আগামীকাল ই রওনা হবো ঢাকার জন্যে! 

হেনা বেগম মুখ কালো করে বসে রইল। জলের মন খুশিতে ভরে উঠল! আল্লাহকে ধন্যবাদ দিতে দিতে সে বললঃ যাক! আমার মনের ডাক তুমি শুনেছ আল্লাহ!  আমি অনেক হ্যাপি! কাল ওকে গিয়ে যে কি ভাবে জড়িয়ে ধরে মাফ চাইবো তুমি দেইখো!



**** সবাই দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেছে, জান্নাত হঠাৎ আবার ফিরে এসে অন্তুর হাতে একটা চিরকুট দিয়ে বললঃ স্যার, এটা একটু পড়ে দেখবেন, আর এটা নিয়ে কাউকে কিছু বলবেন না প্লিজ? কথাটা বলে দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে গেলো। 

অন্তু অনেক অবাক হয়ে গেছে তবু জান্নাত চলে যাওয়ার পর সে চিরকুট টা খুলে দেখল কি লিখা আছে.........

"আমি জানি না আমি আপনার যোগ্য কি না, তবে আমি জলের মতো বেঈমান না, আমি আপনাকে বিশ্বাস করে বলছি- I love you! ইতি- (J)


 চিঠিটা পড়ে জলের কথাটা মনে হয়ে গেলো অন্তুর! সাথে সাথেই রাগ টা বেড়ে গেলো আর বিরক্তিকর লাগলো জান্নাতের সব কথা! সে মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছে.....কারো সাথে সম্পর্কে জড়াবে না! ভুল একবার করেই বুঝেছে ভালোবাসার নামে প্রতারণা করার ফলে কি করে সবকিছু ছন্নছাড়া হয়ে যায়। 
সে রাতে অন্তুর আর ঘুম আসলো না। মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখলো সেই অপরিচিত নাম্বার থেকে আবারো ৬ টা মিস কল উঠে আছে! মোবাইলটা এতো খালি কখনো রাখে না অন্তু কিন্তু এ কয়েকদিনের জলের কথা চিন্তা কর‍তে করতে ওর মন টা এতোটাই ই বেখেয়ালি হয়ে গেছিল যে সব ই ভুলে যাচ্ছিল। অন্তু গম্ভীর হয়ে গেছে আগের চেয়ে অনেক। এখন আর ওর জলের কথা একদম ই মনে পড়ে না! বদলে নিয়েছে সে নিজেকে নিজের মতো করে। বিছানায় এপাশ ওপাশ করতে করতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে বুঝতেই পারল না।

জল অনেক ছটফট করতে লাগল! জান্নাত এটা কি বলল! অন্তু আমার নাম ও শুনতে চায় না! আমার অপরাধ টা কি এতোই বেশি ছিলো যে, ও আমাকে মাফ করতে পারবে না! আমি ত স্বিকার করছি আমার ভুল হয়েছে তবু কেন ও একবার ও ফোন টা ধরছেনা! কেন একটা মিস কল ও দিতে চায় না! ভালোবাসতে যখন চাইছি তখন কেন অন্তু আমাকে এতো কাঁদাচ্ছে! কথাগুলো ভাবতে ভাবতে জলের দুচোখ ভিজে উঠল। সে তবু আরেকবার অন্তুর মোবাইলে কল দিল! আগের মতোই রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরল না। ভালোবাসা কি অবঅহেলার কাছে হেরে যাচ্ছে! হয়তোবা.........নাহ! আমি হারতে দিবো না! আমি দরকার হলে ওর পায়ে ধরে কালকে মাফ চাইবো! এসব সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জল ঘুমিয়ে পড়ল।

No comments:

Post a Comment