Wednesday, March 18, 2020

"সেই তুমি " পর্বঃ ১১



দেখতে দেখতে জলের সাথে অন্তুর প্রেমের ১মাস হয়ে গেছে। এ এক মাসে জল অন্তুর প্রতিটি কথা মাথা নত করে বিনাদ্বিধায় মেনে চলেছে যার ফলে জলের জন্য অন্তুর মায়া, ভালোবাসা আগের চেয়ে দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। বিশ্বাস বেড়ে গেছে জলের প্রতি। হয়তো আরো বাড়তো যদিনা সেদিন এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা টা ঘটতো। 

প্রতিদিনের মতো অন্তু জলের জন্য বাসায় অপেক্ষা করছিল। রেলিশনের ১ মাসে জল কোনদিন ১ মিনিট ও দেরি করে নি কিন্তু আজকে সবাই চলে আসার পর ও আরো ২০ মিনিট হয়ে গেলো, জল আসেনি.....জল না আসাতে অন্তুর অনেক অস্থির লাগছিল, কাউকে পড়াতে ভালো লাগছিল না। অন্তু এতোটাই অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল যে জান্নাত অনেক বার বলার পর ওর ডাক অন্তুর কানে পৌছে নি। তাই জান্নাত কিছু টা রেগেই বললঃ 
স্যার, একজন নেই তারমানে ত এটা না যে আপনি বাকিদের ভুলে যাবেন! আমরাও ত পড়তে আসছি নাকি! 

জান্নাতের গলায় স্লেজ টের পেয়ে অন্তু স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বললঃ ওহ! সরি! তোমাদের ত মেথ করা হয়নি, দাও করে দিচ্ছি!  

জান্নাত মুখ ভেচকি দিয়ে বললঃ না থাক! আপনি ত আবার চিন্তায় মগ্ন তাই বিরক্ত করতে চাইনা! তবে এটা ঠিক যে, জল না থাকলে আপনি আমাদেরকে ভালো করে পড়ান না। 

নন্দিনি হেসে বললঃ দেখতে হবে তো! আমরা ত আর জলের মতো না, তাই না স্যার?

ওদের কথাতে অন্তুর ধ্যান নেই, সে মনে মনে নানান চিন্তা করতে লাগলো। কেন এলোনা, কি হতে পারে ইত্যাদি নানা ভাবনা ওকে আরো বেশি অস্থির করে তুললো।  জল না আসাতে অন্তুর যতোটা খারাপ লাগছে ঠিক ততোটাই ভালো লাগছিল জান্নাতের। আজ কিস ডে। জল না আসাতে অন্তুর সাথে জলের দূরত্ব যেনো আরো বাড়ে জান্নাত মনে মনে সেই দোয়া করতে লাগল। অন্তু আর জলের রেলিশনের ব্যাপারটা একটু আধটু সবাই জেনে গেছে তাই সবাই বুঝতে পারল আজকে আর ওদের পড়া হবেনা কারন অন্তু ওর নিজের ভিতর নেই!

অন্তু র দিকে পলকহীন চোখে জান্নাত কে তাকিয়ে থাকতে দেখে নন্দিনি গলা কাশি দিয়ে বললঃ অন্যজনের জিনিস এতো দেখিস না, বিপদে পড়বি।

জান্নাত হেসে উঠল কিন্তু মুখে কিছু বলল না। অন্তু র মনে নানা প্রশ্ন বাসা বাধতে থাকলো। মনটা,ভারী হয়ে উঠল এসব চিন্তায়। হঠাৎ দরজায় কে যেনো নক করল।  তানহা ভেতর থেকে এসে দরজা খুলতেই রুমে আহমেদ আর সাজু প্রবশ করল। সাজু হাঁপাতে হাঁপাতে বললঃ 
স্যার, একটা পাক্কা খবর নিয়ে আসছি আপনার জন্যে! 

সাজু আর আহমেদ এর এই সময় আসার কারন অন্তু জানে। ওরা জলের খবর নিয়ে আসছে কারন অন্তু জলের গতিবিধি লক্ষ্য রাখার জন্যে ছেলেদের বলে রেখেছিল। কারন ছেলেরা সকল পাড়ায় ঘুরে তাই জল যদি অন্তুকে না বলে কোথাও যায় তাহলে কারো না কারো চোখে পড়বেই। অন্তুর ভয় হচ্ছিল, হয়তোবা জল কে ওরা কোথাও, কারো সাথে দেখেছে! অন্তুর দিকে তাকিয়ে আহমেদ বললঃ 
স্যার, আমি আর চিকনা (সাজু) মেলায় গেছিলাম ঘুরতে, সেখানে দেখি আমাদের......মেনশন নট, আই হোপ আপনি বুঝতে পারছেন কার কথা বলতে চাইছি! 

অন্তু কিছু একটা বলতে চাইছিল ওর মুখ থেকে কথাটা বের করার আগেই জান্নাত বললঃ মেনশন না করতে চাইলেও আমরা জানি আপনারা কার কথা বলবেন! জল আজকে মেলায় যাবে আমাদের আগেই বলেছিল, স্যার কে বলতে মানা করছিল কারন স্যার জানলে যেতে দিবেনা। জল ওর মামা মামির সাথে গেছে সাথে একটা ছেলেও আছে.....

নন্দিনর পছন্দ হলো না জান্নাতের কথা বলার ঢং টা তাই সে তড়িঘড়ি করে বললঃ স্যার, ছেলে মানে.....ওর চাচাতো ভাই। 

সাজু হেসে বললঃ পোলা ত পোলা ই, আপন ভাই ছাড়া সবাই ই ত অন্য কিছু হতে পারে! ঠিক বলি নাই স্যার?  
 ওদের কারো কথায় অন্তুর মনোযোগ নেই কারন ও যখন শুনছে জল বাসা থেকে বের হয়েছে তাও ওকে না বলে তারউপর সাথে ছেলে আছে অন্তুর মেজাজ এতোটা ই খারাপ হলো যে ওর হাত পা কাঁপতে লাগলো। অন্তু সবাইকে উদ্দেশ্যে করে বললঃ 
আমার.....শরিরটা ভালো লাগছে না.....যদি তোমাদের অসুবিধা না হয় তাহলে আজকে ছুটি তোমাদের।

ছেলেরা মাথা নাড়ল কিন্তু জান্নাত বললঃ স্যার, সবাই চলে গেলেও আমি এতো আগে বাসায় গেলে আব্বু বকবে, বলবে কি পড়ছি মাত্র ৩০ মিনিটে, আমি থাকি? আমি কোন ডিস্টার্ব করবো না আপনাকে।আপনি ভিতর ঘরেই থাকেন, আমি জাস্ট বসে থাকবো।

অন্তু আগেই জানে জান্নাত কেন থাকতে চায় তাই সে বললঃ না, বাসায় যাও, বইল স্যার অসুস্থ তাই আজ আগেই ছুটি দিয়ে দিছে।
 
জান্নাতের চেহারাটা অন্ধকার হয়ে গেলো, সে ব্যাগ নিয়ে রেগে উঠে বেরিয়ে যেতেই আহমেদ নন্দিনির দিকে তাকিয়ে বললঃ ওই তোমার বান্ধবীর কি এলার্জি আছে নাকি? ওয় এতো লাফায় কেন? 
নন্দিনি ঠোঁট উল্টে দু দিকে মাথা নাড়ল।  

অন্তু ভিতরের রুমে ঢুকে বাতি নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। সব বিরক্ত লাগছে ওর! মনে হচ্ছে চোখে ঝাপসা দেখছে সব।এভাবে এতোক্ষণ শুয়ে ছিল অন্তু বলতে পারবেনা, যখন চোখ খুলল দেখলো বাতি জ্বালিয়ে জল সামনে দাঁড়িয়ে দাঁত দিয়ে নখ কাটছে আর অন্তুর দিকে তাকিয়ে আছে! অন্তু জল কে দেখে খুশি হওয়ার পরিবর্তে রেগে গেলো! সে চেচিয়ে উঠলোঃ 
"সামনে থেকে দূরে যাও"! আমার কাছে আসছো কেন! 

জল অবাক হয়ে বললঃ মানে! আমি তোমার কাছে আসবো না তো কই যাবো! জান, আজকে বাসায় এতো কাজ ছিলো যে আসতে পারিনি, আম্মু দেয় ই নি বের হতে! 

জলের পরিস্কার মিথ্যে কথাতে অন্তু আরো রেগে গেলো।  সে বিছানা থেকে উঠে বসে বললঃ শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করতাছ কেন? আমি ত  জানি তুমি কোথায় গেছিলা! মেলাতে যাওয়ার এতো শখ? ঠিক আছে! যাও মেলায়, ভাই না, সাথে যতো ছেলে পারো নিয়ে যেও, আমার কিছু বলার নেই।

অন্তুর কথাগুলি জলের গায়ে কাঁটার মতো লাগছিল।  সে মাথা নিচু করে বললঃ তুমি কষ্ট পাবে তাই বলিনি, মামা মামির সাথে গেছিলাম, ওনারা আম্মু আব্বুর সামনে এতো জোড়াজুড়ি করতে লাগলো যে না করেও যেতে হয়েছে। আর আমাদের সাথে যে ভাইয়া টা গেছে উনি বিবাহিত। উনার বৌয়ের জন্য চুড়ি কিনতে গেছে, কাল ভালোবাসা দিবস ত তাই........কথাগুলি বলে জল অন্তুর পায়ের কাছে বসে অন্তুর হাত দুটি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বললঃ Sorry jaan, এমন ভুল আর হবে না! আমি কখনো আর তোমাকে না বলে কোথাও যাবো না, সত্যি বলছি!

জলের কথার কোন প্রভাব অন্তুর উপর পড়ল না। সে ঝাড়া দিয়ে হাত সরিয়ে নিয়ে বললঃ এসব নাটক অন্য কারো কাছে গিয়ে করেন! যেসব মেয়েরা ছেলে নিয়ে ঘুরতে পারে তারা,সব ই করতে পারবে। দয়া করে আর আমার সামনে আইসেন না। প্লিজ বাসায় জান!

অন্তুর ব্যবহার টা জলের অনেক খারাপ লেগেছে, তার চোখে পানি এসে পড়লো।  জল অন্তুর দিকে তাকিয়ে ই রইল। অন্তুর মন তবু নরম হলোনা। জল অন্তুর দিকে তাকিয়ে চোখ মুছতে মুছতে বললঃ 
"আম্মুকে বলে এসেছি বই দাগাতে আসছি, তাই দেরি করতে পারবো না, তুমি মাফ করবা না আমাকে"?  

অন্তু আরো রেগে গেলো।  সে মুখ ঘুরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে বললঃ কুত্তা ও মানুষের সাথে কয়েক দিন মিশলে পরিবর্তন হয় আর মানুষ হয়েও নষ্টামি ছাড়তে কষ্ট যেহেতু হয় আমার কাছে আসার কোন দরকার নেই। বাসায় জান।

জল আর সহ্য করতে পারছিল না। ওর দুচোখ ভরে উঠল পানিতে। চোখ দুটি ছলছল করছিল। সে দ্রুত বের হয়ে গেলো দরজা দিয়ে। জল চলে যাওয়ার পর অন্তু আবার শুয়ে পড়ল আর মনে মনে বললঃ 
'আমি সব সইতে পারবো কিন্তু তোকে অন্য কারো সাথে ভাগ করা সইতে পারবো না'!!


*** রাত যতো গভীর হতে লাগলো জলের মন ততোই ভারী হয়ে উঠল,  দুচোখ ভিজে যাচ্ছে কান্নায়! কিন্তু পাশেই মা আর ছোট বোন ঘুমাচ্ছে তাই চিতকার করে কান্না করার ও উপায় নেই........আজকে মোবাইলটাতে ও ব্যালেন্স নেই! মনে মনে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে জলের হঠাৎ মনে হলো কাল ১৪ ই ফ্রেব্রুয়ারি!!!  অন্তুর জন্মদিন!! কথাটা,একেবারেই ভুলে গেছে সে!! তাড়াতাড়ি চোখ মুছে চুপিচুপি পাশের ঘরে গেলো। দেখলো বাবা ঘুমিয়ে আছে তাই আস্তে পা টিপে টিপে বাবার মোবাইলটা নিয়ে বারান্দায় চলে এলো। বুক কাঁপছে! হাতটা ও ঠান্ডা হয়ে আসছে! তবু বুকে সাহস নিয়ে বাম হাত দিয়ে মুখটা মুছে অন্তুর নাম্বার টা ডায়েল করল! 
একবার, দুবার..... এভাবে ৪ বার রিং হওয়ার পর অন্তু ফোন টা রিসিভ করল।

অন্তুঃ হ্যালো!........ হ্যালো???
জল নিরব হয়ে রইল, ভাষা হারিয়ে ফেলেছে, কি বলবে বুঝে উঠতে পারছেনা তাই বড় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ফোনটা কেটে দিলো। 

অন্তু বুঝতে পেরেছে রাত ২ টায় জল ছাড়া আর কেউ কল দিবে না তাই মোবাইলটা রেখে দিল। শুয়ে পড়েছে সে কিন্তু ২ মিনিট পরই আবার ফোন টা বেজে উঠল!  কলটা রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে কান্নাভেজা কন্ঠে জল ফিসফিস করে বললঃ 
Happy Birth Day!  

জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানিয়েই জল কলটা কেটে দিলো।  অন্তুর ভয়েজটা ওর অনেক ভালো লাগে,আগেও অনেকবার অন্তুকে কথাটা জল বলেছে কিন্তু অন্তু গুরুত্ব দেয়না এসব। আজকে হ্যালো শব্দটা মনের ভিতর গেঁথে আছে! জল আবার চুপি চুপি বাবার রুমে গিয়ে ফোন টা রেখে মায়ের পাশে এসে শুয়ে পড়ল। ঘুম আসছেনা! 

'অন্তু এতো ছোট একটা ব্যাপারে এতো রাগ করল কেন'.....ও আমার সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করতে পারে ভাবতেও পারিনি! নিজের মনেই কথাগুলো বলতে বলতে দুচোখ আবারও ভিজে উঠল ওর।


অন্তুর  ঘুম আর হবে না বুঝতে পেরেছে সে, কারন জোড় করে ভুলে থাকতে চাইলেও ওর মনের ভেতরে জলের জন্য চাপা উত্তেজনা কাজ করছিল। জলের কান্নাভেজা কন্ঠটা ওর অনেক খারাপ লেগেছে তবু নিজের জেদ এর কাছে মাথা নত করতে চায়নি। এসব ভাবতে ভাবতে মোবাইলটা হাতে নিয়ে এফ, বি তে ঢুকার জন্য লক খুলতেই দেখলো অন্য একটা নাম্বার থেকে ৫ টা SmS আসছে। এস এম এস অপেন করতেই দেখল বার্থডে শুভেচ্ছা জানিয়ে জান্নাত ৫ টা এস এম এস করে রেখেছে যার পুরোটা জুড়েই I Love you লিখা!

No comments:

Post a Comment