সালঃ২০১০, মার্চ মাস;
সময়টা SSC exam এর। আমাদের দেশে তখন ম্রেট্রিক পরিক্ষাটা মার্চ মাসেই শুরু হতো আর প্রতিটি পরিক্ষার ভিতর প্রায় ২/৪ দিন করে বন্ধ থাকতো। যার ফলে ১৪ টা পেপার দিতে প্রায় ১মাসের উপরে সময় লেগে যেতো। গ্রামে সাধারণত পরিক্ষার কেন্দ্রগুলো অনেক দূরে হয়। কারো কারো পরিক্ষার কেন্দ্র ত ৫ গ্রাম পড়েও পড়তো। যার ফলে বেশিরভাগ ছাত্র ছাত্রীদেরই যাতায়াতে অনেক অসুবিধা দেখা দিতো ফলে পরিক্ষা শুরু হওয়ার ১মাস আগেই কেন্দ্রের আশে পাশের গ্রামগুলোতে তারা সেই এক মাসের জন্যে বাসা ভাড়া নিয়ে রাখতো। বাবলুর বেলায় ও তেমন ই হলো। বাবলু ssc পরিক্ষার্থী ছিলো। ওর স্কুলের কেন্দ্র পড়েছিল ওদের গ্রাম থেকে ৪/৫ গ্রাম পরে রূপসদী তে। রূপসদী কুমিল্লার অন্তর্ভুক্ত অনেক প্রাচীন আর অনেক বৃহৎ একটা গ্রাম। চার পাশের গ্রামগুলোর তুলনায় এ গ্রামটি সবচেয়ে বেশি আকর্ষণীয় ছিল জমিদারি আমলের বাড়িঘরের জন্যে আর বিশাল খাল হ্রদের কারনে। যাই হোক, বাবলু ও অন্যদের মতো ওর পরিবারের সম্মুতিতে রূপসদী গ্রামে বাসা ভাড়া নেওয়ার জন্যে গেলো। ওর সাথে ছিল ওর সেজো ভাই রাতুল। যেহেতু আর এক সপ্তাহ পরেই এস, এস, সি এক্সাম শুরু হয়ে যাবে তাই শেষ মূহুর্তে বাসা ভাড়া নিতে এসে বাবলুদের প্রায় দিশেহারা অবস্থা। রাতুল যখন এস,এস,সি এক্সাম দিয়েছিল তখন ও এই গ্রামেই ওদের পরিক্ষার কেন্দ্র ছিল। রাতুল যখন বাবলু কে নিয়ে সেই কেন্দ্রের কাছে এলো তখন প্রায় মধ্যবিকেল হয়ে গেছে। রোদের তীব্রতা নেই বললেই চলে। হালকা হাওয়া বইছে। সাধারনত মার্চ মাসে প্রচন্ড গরম পড়ে। রূপসদীতে গরমের তীব্রতা আরো বেশি এর কারন হলো এ গ্রামের কোথাও মাটি নেই, নদি নেই.....আছে শুধু বালি আর খাল!
রাতুল বাবলুর সেজো ভাই হলেও ওদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক টা বন্ধুর মতো ই। রাতুল একদম সাদা মনের মানুষ। সহজ সরল আর চঞ্চল স্বভাবের। কোন জায়গায় গেলে সে জায়গার অতীত ঐতিহ্য নিয়ে বিস্তারিত না বলতে পারলে রাতুলের পেটের ভাত হজম হয় না! তাই ওরা দুজন যখন কেন্দ্রের সামনে এসে উপস্থিত হলো, রাতুল হাত দিয়ে ইশারা করে বাবলু কে দেখিয়ে বললঃ
"দেখ! এইটা তোদের কেন্দ্র! আমরাও এই কেন্দ্রেই পরিক্ষা দিয়েছি! কি সুন্দর"!
বাবলু দেখলো চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আছে বিশার বড় এক বিদ্যালয়ের গেট যার উপর বড় করে লিখা আছে" রূপসদী বিন্দাবন উচ্চ বিদ্যালয়"
বিদ্যালয়ের গেট তালা দেওয়া তাই ভেতরে ঢোকার সুযোগ তখন ওদের হয়নি। খুব সুন্দর আর মনোরম পরিবেশ বাবলুর মন কে খুশি করে তুলল! সে দাঁত বের করে হেসে বললঃ সত্যি অনেক সুন্দর কিন্তু অনেক পুরাতন!
বাবলুর কথায় রাতুল ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললঃ তুই সুন্দরের কি বুঝিছস! যে জিনিস যতো পুরান হবে সে জিনিসের সৌন্দর্য ততোই বাড়বে! মূর্খ কোথাকার!
শেষের কথাটায় বাবলুর দাঁত বন্ধ হয়ে গেলো। সে চোখ গোল করে ফেলফেল করে তাকিয়ে রইল।
রাতুল ছেলেবেলা থেকেই ছিল কবি স্বভাবের আর প্রকৃতি প্রেমি।বলা বাহুল্য, এক ই সাথে বিশ্বপ্রেমিক বললেও ভুল হবে না কেননা প্রেমের যদি রেকর্ড গননা করা হতো তাহলে এতোদিনে সেঞ্চুরি করে ফেলতো!!
অনেক খোঁজাখুঁজি করেও যখন কোন বাসা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন রাতুলের দেখা হয়ে গেলো ওর সাথে পরিক্ষা দেওয়া এক বন্ধুর সাথে। রাতুল অনেক মিশুক স্বভাবের ছেলে তাই সহজেই সবার মন কাড়তে পারে। রাতুল কে দেখে আবির ডাক দিতেই দুজন ঘাড় ফিরিয়ে তাকালো। রাতুল হেসে উঠল আবির কে দেখে কিন্তু বাবলু যেনো চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা ভূত দেখছিল! সে নড়তে পারছিল না, হা করে তাকিয়ে রইল! ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে ভূতটা,হাসছে,এদিকেই আসছে!!
ভয়ে সারা গা কাটা দিয়ে উঠল বাবলুর! কি ভয়ানক চেহারা! আসলে ভয় পাওয়ার ই কথা কারন আবিরের সারা দেহের বেশিরভাগ জায়গায় ই এসিডে ঝলসে গেছে, বিশেষ করে মুখটা! শুধু চোখ দুটো কিছুটা ভালো আছে, যে কোন মানুষ প্রথম দেখাতে আবির কে ভূত ই ভাববে!
আবির পোড়া মুখে হেসে রাতুলের দিকে তাকিয়ে বললঃ কি দোস্ত, তুমি এখানে?
রাতুল বাবলুর দিকে দেখিয়ে বললঃ আমার ছোট ভাই, ও এবার পরিক্ষার্থী, ওর জন্যে বাসা খুঁজতে আসছি।
ওদের কথোপকথন এ বাবলু মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল! ও আগে কখনো এসিডে ঝলসে যাওয়া কাউকে দেখে নি তাই ওর কাছে আবির কে প্রথম ভূত মনে হয়েছিল!
আবির বললঃ দোস্ত তোমরা অনেক দেরি করে আসছ, এতোদিনে ত সবাই ভাড়া নিয়ে নিছে, চলো তবু একটু খুঁজে দেখি।
আবির কে সাথে নিয়ে রাতুল আর বাবলু প্রায় ৩ ঘন্টা খুঁজার পর স্কুলের সামনেই একটা বাসা পেলো। বাসার মালিক থাকেন সৌদিতে, বাসায় শুধু ওনার বৌ, দুইটা মেয়ে,বৃদ্ধা মা থাকেন। বাসা টা সবার ই পছন্দ হলো। ওদের কে যে রুম টা দেওয়া হলো ওই ঘরে প্রবশ করে চারদিন ভালো করে দেখে সন্তুষ্টির হাসি ফুটলো সবার মুখে। বাবলু দেখলো পড়ার টেবিলের সামনে বসলে সোজা মাঠ টা দেখা যায়, বিশাল বড় মাঠ! যার ঠিক মাঝখান জুড়ে শত বছরের পুরানো একটা বিশালাকার বট গাছ দাঁড়িয়ে আছে! জায়গাটা খুব সুন্দর আর ভৌতিক! রাতুল বাসার মালিকের বৃদ্ধা মায়ের সাথে যখন সব কথা পাকা করছিল, দরজার আড়ালে দাঁড়িয়ে বৃদ্ধার বড় নাত্নী উকি দিয়ে বাবলুর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসছিল! ব্যাপার টা রাতুল বাবলু দুজন ই খেয়াল করল। সব কথা পাকাপোক্ত করে ওরা যখন এডভান্সড দিয়ে বেরিয়ে আসলো তখন প্রায় সন্ধ্যা ৭টা বেজে গেছে! যা এই গ্রামের জন্যে অনেক রাত!!
No comments:
Post a Comment