আবিরের কথায় রাতুলের হুশ হলো! সবাইকে নিয়ে রাতুল জমিদার বাড়ির ভিতর ঢুকলো। সিড়িগুলো এখনো অনেক মজদুত আছে! বাড়ির দেয়ালগুলোতে আগাছা জন্মে আছে। গা ছমছমে রহস্যময়তায় ভরা যেন এক মৃত্যুপুরী এটা!! সবাই পপির কাছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে গম্ভীরমুখে একে অন্যের দিকে তাকাতে লাগলো। রাতুল পপির নাকে পাশে হাত নিয়ে পরিক্ষা করল জীবিত আছে কি না!....... হ্যাঁ..... জীবিত!
রাতুল চেঁচিয়ে সবাইকে নির্দেশ দিলো পপিকে কে নিচে নিয়ে যেতে।সবাই ধরাধরি করে কোন রকমে পপিকে যখন গ্রামের ভিতর নিয়ে আসছিল আশেপাশের বাড়িগুলোতে তখন রীতিমতো গবেষণা শুরু হয়ে গেছে!! এ বিষয়টা যে যেমন পারছে তেমন ই ব্যাখ্যা দিতে শুরু করেছে!!
পপির মা আর দাদী প্রায় জ্ঞান হারানোর অবস্থা! পপির দাদী তো রীতিমতো মাতম শুরু করে দিয়েছে! সবাইকে উদ্দেশ্য করে টেনে টেনে বলতে লাগলোঃ যদি....আ-মার না-ত--নীর কিছু হয় তোগোরে জেলে দিমু গোলামেরা!! আমার একটা ই মাত্র না-তনী! আল্লাহ বাঁচাও আমার নাতনীরে!!
কেউ একজন গিয়ে হরিবল তান্ত্রিক কে খবর দিলো। হরিবল এসে ঘটনা পর্যবেক্ষণ করে গম্ভীর হয়ে বললঃ হুম্........ ঘটনা বেশি ভালা না! পপিরে ডাকিনী ধরছিল! ভগবানের কৃপায় এ যাত্রায় বেঁচে গেছে তবু স্বাভাবিক হতে সময় নিবে!!
ঘটনা টা সবার মনে গেঁথে গেলো। সেদিনের পর থেকে কেউ ই আর বাহিরে তেমন আড্ডা দিতে বের হতো না। রাতুল রা গ্রামে আসার পর থেকেই খেয়াল করল সন্ধ্যার পর পর ই পুরো গ্রামের আবহাওয়া কেমন যেনো থমকে যায়! স্তব্ধতায় ঢেকে যায় পুরো গ্রাম। ভয়ানক লাগে তখন। নেহায়েত অতি আবশ্যক কোন কাজ ছাড়া কেউ তেমন একটা বের হয় না! যাই হোক দেখতে দেখতে পরিক্ষা প্রায় শেষের দিকে চলে এলো। আর মাত্র ২ টা পরিক্ষা আছে। দুটা পরিক্ষা দিতে সময় লাগবে ৭ দিন! তাই একটু রিলাক্স মুডে ই রইল সব পরিক্ষার্থী রা। এ কয়েক দিনে সবার মন থেকে ভয় টা দূরে সরে গেছে। গ্রামের কোথাও মেলা বসেছে। গ্রামের বেশিরভাগ কিশোর কিশোরীরা সেখানে যাচ্ছে। বাবলু,আনিকা,পপি সহ আরো কয়েক জন পরিক্ষার্থী ও গেলো মেলা দেখতে। রাতুল যায় নি। সে মাঠের মাঝে বিশালাকৃতির বটগাছের নিচে বসে আবির, জামাল, কাদের সহ আরো কয়েক জন স্থানীয়দের সাথে বসে আড্ডা দিচ্ছিল। কথায় কথায় বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নেমে আসল। আড্ডা টা মাতিয়ে তুলল রাতুল গান গেয়ে তাই কেউ টের ই পেলো না কখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে.…....রাতুল গান গাইছিল হঠাৎ ওরা দেখলো ওদের দিকে একটা মহিলা এগিয়ে আসছে! কোলে একটা বাচ্চা, পড়নে সাদা রং এর একটা শাড়ি.... আবির কে তাকিয়ে থাকতে দেখে সবাই হেসে উঠল। রাতুল গান থামিয়ে বললঃ ভিখারি হবে শিউর ই।
মহিলা টা ওদের সামনে দিয়ে হেঁটে চলে গেলো,বাচ্চাটা কান্না করছিল, অন্ধকারে মহিলার মুখ বোঝা গেলোনা.........
***রাতুল হাসি তামাশায় সবাইকে মাতিয়ে তুললো। বন্ধু বান্ধবরা সবাই আড্ডাতে এতোটাই মশগুল ছিল যে খেয়াল ই করেনি কখন যে সবাই হাঁটতে হাঁটতে পুরাতন সেই শশ্মশান ঘাটে এসে পড়েছে! রাতুল যখন গান থামালো তখন সবার হুঁশ হলো। সাজিদ নামের একজন রাতুলের দিকে তাকিয়ে চোখ কটমট করে বলল-
তুই আমাকে আগে বললি না কেন! আমি যদি জানতাম তোরা শশ্মানে আসবি আমি কখনোই আসতাম না! আমি এক মার এক ছেলে!
কথাটা বলেই সাজিদ মেয়েদের মতো চোখ মুছতে লাগলো যা দেখে বাকি সবাই হেসে উঠলো। কিন্তু ওদের হাসি মিশে যেতে বেশি সময় লাগলো না কেননা আবির চোখ বড় বড় করে শশ্মানের এক কোনে তাকিয়ে রইল। ওর চোখ অনুসরণ করে বাকিরা যখন সেই দিকে তাকালো তখন সবার শ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হলো! সবাই দেখলো একটু আগের সেই মহিলাটি কোলের বাচ্চাটা কে হাটুর উপর রেখে ডান হাত দিয়ে কলিজাটা টেনে বের করে খাচ্ছে! সারা মুখে রক্ত লেগে আছে! মুখে পৈশাচিক হাসি! ওদের দেখে রক্তমাখা মুখে হাসিটা আরো চওড়া করে হাত ইশারায় ওদের কে কাছে ডাকলো........!!!
এ দৃশ্য দেখে সবার অন্তর আত্মা কেঁপে উঠল! রাতুলের হাত ধরে সাজিদ জোড়ে টান দিয়ে বাবাগো বলে চিতকার করে দৌড় দিলো! ওদের পিছু পিছু বাকিরাও দৌড়ে পালাতে শুরু করলো........ সেই মানুষ খেকো মহিলাটিও ওদের পিছু পিছু ধাওয়া করতে শুরু করল! এ দৃশ্য দেখে একেক জনের জ্ঞান হারানোর অবস্থা প্রায়!!
এভাবে এতোক্ষণ দৌড়েছে কেউ বলতে পারবেনা, ওদের যখন হুঁশ ফিরলো তখন দেখলো ওদেরকে ঘিরে আছে গ্রামের শ খানেক লোক, সবাই ওদের নানান কথা জিজ্ঞেস করছিল........কিন্তু কারো কথায় ওদের কান নেই, সব শেষে এরা বেঁচে আছে এটা ভেবে দীর্ঘ একটা নিশ্বাস ছেড়ে সবাই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলো আর ওয়াদা করলো আর ভুলেও কখনও শশ্মান ঘাটে যাবে না কেউ.......রাতুল সেদিন বাসায় ফিরেই বাবলু আর আনিকাকে ব্যাগ গুছাতে বলল..........এখানে আর এক মূহুর্তও নয়........
(শেষ)
No comments:
Post a Comment