Wednesday, April 8, 2020

"ভয়ংকর সন্ধ্যা " পর্বঃ ২



পরিক্ষার আর মাত্র দুদিন বাকি আছে তাই বাবলু জোড়াজুড়ি করতে লাগলো আজকেই জিনিস পত্র নিয়ে ওই বাসার উদ্দেশ্যে রওনা দিতে.......রাতুল বাসায় ছিল না তাই মায়ের কানের কাছেই ঘ্যানঘ্যান করতে থাকলো বাবলু।

বাবলুরা ছিল ৫ভাই, ৪ বোন। ওর বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরিজীবী। অল্প বয়সেই তিনি ব্রেনস্টোক করে মারা যান যার ফলে বাবলুর বড় ভাই প্রবাসী হতে বাধ্য হন পরিবারের তাগিদে। বাবলুর মা শায়লা বেগম অনেক কষ্ট করে স্বামির অবর্তমানে সন্তানদের মানুষ করেছেন। বাবলু কে নিয়ে উনার গর্ব অনেক কারন অন্যদের তুলনায় বাবলু পড়াশোনায় একটু এগিয়ে ছিল, মেধা ভালো থাকায় মায়ের আদর টাও বেশিই পেয়েছে।যাই হোক,শায়লা বেগম কিছুতেই দুই দিন আগে যেতে দিতে নারাজ। বাবলু অনেকক্ষন চেচামেচি করলেও তেমন কোন ফল হয় নি দেখে মুখ ভার করে বড়ুই গাছের নিচে বসে রইল।

বাবলু মনে মনে বললঃ আমি ত আজকেই যাবো, দরকার হলে ঝগড়া করবো! ইস কত সুন্দর গ্রাম, এক দুই দিন আগে গিয়ে গ্রামটা দেখতে হবে না!

এমন করে অনেক ক্ষন ভাবার পর উঠতে যাচ্ছিল এমন সময় বাবলুর মেঝো বোন আনিকা এলো। সে চোখ দুটো গোল করে বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললঃ কিরে! এতো যাওয়ার জন্যে পাগল হইছস ক্যান, কি আছে ওই গ্রামে? পরিক্ষা দিতে যাবি নাকি ভ্রমন করতে?

বাবলু হেসে বললঃ আরে তুই জানস না, কি সুন্দর গ্রাম! পুরা ই ছবির মতো! আর অনেক ভয়ানক!
আনিকা হেসে বললঃ আমি ও যাচ্ছি তোদের সাথে! একা যেতে পারবি না, রাতুল ভাইয়া তুই আর আমি যাবো।

বাবলু হেসে বললঃ তাই নাকি! তুই গেলে ত আমার ভালো ই হয়, ওই বাসায় একটা মেয়ে আছে, পটাইয়া দিবি আমাকে!
আনিকা বাবলুর দিকে নাক ফুলিয়ে ভ্রু কুচকে তাকিয়ে বললঃ

"আজেবাজে কথা কম বল! পরিক্ষা দিতে গিয়ে এসব করলে পরিক্ষা খারাপ হবে আর আম্মা জানতে পারলে জুতা দিবে তোকে"!

বাবলু মুখ কালা করে বললঃ আরে! মজা ও বুঝোস না! আমি ত এমনি মজা করে বলছি!
আনিকা বাবলুর দিকে তাকিয়ে রইল কিন্তু কিছু বলল না কারন সে জানে বাবলু কথাটা দুষ্টমি করে বলে নি, বাবলু যেখানেই যায় মেয়েদের আড্ডা থাকেই তাই কথাটা যে নিছক দুষ্টমি ছিল না তা আনিকা বুঝেই চুপ করে রইল।

দুপুর আনুমানিক ১২টার দিকে যখন রাতুল বাসায় এলো তখন শায়লা বেগম ই আগে বললেন বাবলুর মালপত্র আজকে নিয়ে যেতে। বাবলু মন খারাপ করে ছিলো কিন্তু মায়ের কথায় ওর মন সাথে সাথেই ভালো হয়ে উঠল।

শায়লা বেগম বললেনঃ মাল পত্র রেখে চলে আসিস, আগামীকাল মিলাদ পড়ানোর পর চলে যাস আনিকা আর রাতুল কে নিয়ে। আনিকা রান্না করবে।

রাতুল একটু আলসে প্রকৃতির! সে সহজে কোন জায়গায় নড়তে নারাজ তাই একটু বেকে বসলো। শায়লা বেগমের অনেক জোড়াজুড়ির পর রাতুল বাজার থেকে অটো রিক্সা নিয়ে এলো!
বাবলুর মন খুশিতে ছটফট করছিল! সে আগেই সব বই পত্র,বিছানা, কিছু হারিপাতিল গুছিয়ে রেখেছিল আনিকার সাথে মিলে। তাই অটো আসার পর গাড়ি ভরতে বেশি বেগ পেতে হলো না ওদের। আজকে শুধু রাতুল আর বাবলু ই যাবে, ওরা আবার বিকেল নাগাদ ফিরে আসবে।

গাড়িতে সারা রাস্তা বাবলু মনে মনে ছক কষছিল সেখানে গিয়ে আগে কোন কোন বন্ধু বান্ধবের সাথে দেখা করবে! ওর ধারনাতে এস এস সি ছিলোই না, ওর মনে হচ্ছিল কোথাও পিকনিক করতে যাচ্ছে!!

ঘন্টা খানিক পর ওরা যখন নির্ধারিত বাসার সামনে পৌছল কিছু উৎসুক ছোট ছেলে মেয়ে দৌড়ে এলো অটো রিক্সার সামনে!
ওদের মাঝে কেউ একজন গলা ফাটিয়ে ডাকছিলঃ পপি আপা তোমাগো মেহমান রা আইসা পড়ছে, চালাইয়া(জলদি) আহো(আসো)!!!

রাতুল গাড়ি থেকে নেমে মাল পত্র ভিতরে নিয়ে যাওয়ার জন্যে রেডি হচ্ছিল, সব ছেলে মেয়েরা হুড়োহুড়ি করে মাল পত্র নিজেরা এগিয়ে নিতে লাগলো।

এমন সময় গাড়ির সামনে শ্যামলা চেহারার ১৩/১৪ বছরের একটা মেয়ে এসে দাঁড়াল। বাবলু চিনতে পারলো, সেইদিন এই মেয়েই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে ওদের দেখছিল, বাবলুর মনে হলো অনেকটাই মোটা!

মেয়েটা বলল ঃ ব্যাগটা আমার কাছে দেন মামা!!

রাতুলের হাত থেকে ব্যাগ টা নিতে চাইলে রাতুল অনেক বিনয়ী হয়ে কাচুমাচু স্বরে বললঃ না না! তুমি কেন নিবে, আমি ই নিতে পারবো!

রাতুল ব্যাগ নিয়ে ভেতরে চলে গেলো। বাবলুর মনে মনে রাগ হলো! মামা ডাকে কেন এই মেয়ে!! সব মজা টা ই নষ্ট হয়ে গেলো!

ঘরটা ছোট হলেও পরিবেশ টা খুব সুন্দর, বিশেষ করে জানালার সামনে পড়ার টেবিলে বসছে সামনে বিশাল মাঠ, আর মাঠের মাঝখানে বিশাল বড় বট গাছ টা চোখে পড়ে যা দেখতে অনেক সুন্দর লাগে। বাবলু ব্যাগ থেকে বই পত্র গুছিয়ে টেবিলে রাখছিল, রাতুল বিছানায় চাদর বালিশ রাখছিল হঠাৎ বাইরে কিসের গন্ডগোল শুনি দৌড়ে বেরিয়ে এলো ওরা উঠানে! উঠানে অনেক মানুষ জমে গেছে!! কান্তা নামের কোন এক মেয়েকে নাকি পাশের গাব গাছ থেকে কিসে তাড়া করেছে, মেয়েটা পপির সমবয়সী, এক বাড়িতেই থাকে, দুটা ঘর পরে ওদের ঘর!মেয়েটা হাঁপাতে হাঁপাতে উঠানের উপর শুয়ে পড়লো! জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে!!

ঘটনার আগামাথা বুঝতে রাতুল বাবলুদের কষ্ট হলেও উঠানে উপস্থিত সবার চোখ ই তখন ছানাবড়া হয়ে আছে, কেউ কেউ মেয়ের মাথায়, মুখে পানি ছিটাচ্ছে,আবার কেউ কেউ নানান আজগুবি কথা শোনাচ্ছে।
প্রায় দাঁত নেই বললেই চলে এমন একজন দাদী বয়সী মহিলা পান চিবুতে চিবুতে সবার দিকে তাকিয়ে হাত নেড়ে বললঃ

 "আমি ত আগেই কইছিলাম, চেয়ারম্যান বাড়ির আশেপাশে ভরদুপুরে,  সন্ধায়, রাত বিরাইতে মাতামতি না করতে"! চেয়ারম্যান এর পোলার আত্মা ঘোরে,টঠল দেয়! মাইয়া ডাংগর হইছে, আমাগো উচিৎ কথা ত ভালা লাগে না, এখন বুঝুক,থাপ্পড় টোপ্পড় দিয়া দিছে নি ভালা কইরা তোমরা দেখ! 

বুড়ির পান চিবানো কথার বেশিরভাগ কথাই কেউ না বুঝলেও ঘটনাটা যে বেশ ভয়াবহ ই ঘটেছে তা সবাই বুঝতে পারলো। প্রায় আধা ঘন্টা পর যখন মেয়ের হুশ ফিরল ওর মুখের কথা শুনে উপস্থিত সবার সাথে সাথে রাতুল বাবলুও হা হয়ে তাকিয়ে রইল! 

মেয়েটা কাঁপাকাঁপা কন্ঠে ঘটনার বর্ণনা দিতে লাগলো ঃ

" আমি লাকড়ি কুড়াইয়া চেয়ারম্যান বাড়ির পাশের গাব গাছের নিচে যখন আইছি, আমার মনে হইতাছিল কেউ আমার পিছে আছে! আমি ঘাড় ফিরিয়ে দেখি কেউ নাই! আবার যখন গাব গাছ তলা থেকে একটু সামনে আসছি, দেখি একটা মহিলা বাচ্চা কোলে নিয়া আমার দিকেই আসতাছে!

কিছুক্ষন থেমে থেকে কান্তা আবার বলতে লাগলোঃ আমার সামনে আইসা কয়, আমার কাছে হের কোলের বাচ্চাটারে রাখতে! আমি কইলাম" আমি কেমনে কোলে নিমু, আমার মাথায় লাকড়ির বোঝা দেহেন না! তখন মহলাটা হাত লম্বা কইরা আমার মাথা থেকে লাকড়ির বোঝাটা টানতে লাগলো! কি বড় হাত যে হইছিল আপনারা না দেখলে বিশ্বাস করবেন না!! আমি লাকড়ির ঝুড়ি রাইখা দৌড় দিতেই দেখি মহিলা এক হাতে আমার উড়না টাইনা ধইরা হাসতাছে, আর এক হাতে বাচ্চাটারে আলগাই ধইরা কামড়াইতাছে!! সারা মুখে রক্ত!! আমি কোন রকমে জান লইয়া পলাইছি!!

কান্তার কথা শেষ হতেই আরেক জন বললঃ তোরা ত মুরিব্বিদের কথা হুনোস না! মানা করার পর ও দূষিত জায়গায় ঘোরাঘুরি করস, কোন দিন জানি মাইরা তোগোরে ওই বট গাছে ঝুলাইয়া রাখে, দেখিস!! 

রাতুল ঘটনাটি মনোযোগ দিয়ে শুনছিল কিন্তু বাবলুর ভয়ে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে, সে রাতুল কে বাসায় ফিরে যাওয়ার জন্যে টেনেটুনে বের করে নিয়ে আসলো! 

রাতুল মাঠে বেরিয়ে বললঃ খুব মজার ব্যাপার তো! গ্রামটা দেখেই মনে হয়েছিল এখানে ভূত প্রেত থাকতে পারে! 

বাবলু চোখ গোল করে বললঃ তোমার কাছে কি মনে হয় এই মেয়ে সত্যি কথা বলছে সব? 

রাতুল হেসে বললঃ অবশ্যই সত্যি বলছে, মেয়ের চোখ মুখ ই বলে দিচ্ছে মেয়ের অবস্থা কতোটা খারাপ হয়ে গেছে এই ঘটনায়! 

বাবলু সব জান্তার মতো মাথা নেড়ে সায় দিলো।  ওরা বটগাছ টার নিচে আসতেই বাবলুর মনে কেমন জানি একটা ভয় কাজ করতে লাগলো তাই সে রাতুলের ঘা ঘেসে হাঁটতে শুরু করল! 

ওদের কপাল খারাপ, রাস্তায় কোন রিক্সা বা অটোরিকশা পেলো না তাই বাধ্য হয়ে এই বিকেল বেলা হেঁটে হেঁটেই বাড়ি পৌছার সিদ্ধান্ত নিয়ে গ্রামের ভিতর দিয়ে শটকার্ট রাস্তা ধরে এগুতে থাকলো। 

রাতুল এই গ্রামের খুটিনাটি সব চিনে, জানে তাই বাবলুকে যখন সামনে যা পড়লো তা নিয়েই বড় বড় ইতিহাস শোনাতে লাগলো যার কিছুটা সত্য আবার কিছুটা নেহায়েতই বাবলু কে ভয় দেখানোর জন্যে! ওরা যখন রূপসদী গ্রাম টা ছেড়ে বিশাল ধান ক্ষেতের পাশ ঘেসে হাটঁছিল তখন হঠাৎই রাতুল দাঁড়িয়ে গেলো! বাবলু চোখ গোল করে জিজ্ঞেস করলোঃ 

"কি হইল আবার!  তোমারে ভূতে ধরছে নাকি!! 

রাতুল এক গাল হেসে বললঃ আরে সামনে দেখ! কি বিশাল বড় কবরস্থান!! মাইকপুর কবরস্থান বলে এটাকে!! জমিদার আমলে এই কবরস্থানে হাজার হাজার মানুষকে জ্যন্ত সমাহিত করা হয়েছিল! ওদের আত্মা এখনো ঘুরে ফিরে! যদি আমাদের ধরে.....!!!

বাবলু ঢোক গিলে চোখ সরু করে বললঃ কি কও এইসব!! সত্যি ই যদি ধরে তাইলে আমার পরিক্ষার কি হইবো!! বাসায় আমগোরে না পাইলে কই খুঁজবে আম্মা!!

রাতুল বুঝল বাবলু বেশ ভয় পেয়ে গেছে তাই হেসে বললঃ কি বলিস তুই! আমি সব ভূত প্রেত, ডাকিনী যোগীনির ওস্তাদ!! আমার কাছে আসলে ফু দিয়ে উড়িয়ে দিবো! 

কথাটা বলে গোল করে বাবলুর দিকে তাকিয়ে বললঃ অবশ্য তুই যেই চিকনা! তোরে ত ভূতেরা কোলে করে নিয়েই দৌড় দিবে, তখন অবশ্য তোরে বাঁচাতে আমার আবার একটু শক্তি খরচ হবে, সেটা ব্যাপার না! 

বাবলু ঢোক গিলে চোখ গোল করে ফেল ফেল করে তাকিয়ে মনে মনে বললঃ আরে বাপরে! আমার ভাই এতো বড় ক্ষমতাশালী আগে জান্তাম না! আয় রে ভূত দেখি কেমনে ধরস!!

আরো একটা গ্রাম পার হয়ে ওরা যখন ক্লান্ত হয়ে পড়েছিল বাবলুকে নিয়ে একটা বড় আম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বিশ্রাম নিতে লাগলো রাতুল। 

বাবলু চারপাশে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বললঃ আরে বাহ! গ্রামেও কি আংগুর ফল গাছ আছে নাকি!! 

রাতুল বললঃ কই আংগুর ফল গাছ রে, ট্যাংরা!!!

রাতুলের মুখে নিজের খিতাবী নামটা শুনে বাবলু অপমানিত বোধ করল তাই একটা গাছ দেখিয়ে বললঃ এটা কি গাছ তাইলে? 

রাতুল গাছ টা দেখে হেসে বললঃ তোর ত সেই ট্যালেন্ট,  আমি চিনি নাই, তুই চিনে ফেলেছিস! খাবি নাকি আংগুর ফল? পাড়বো গাছ থেকে? 

রাতুলের কথায় বাবলুর জিবে জল এসে গেছে! তাই তো! খিদে পেয়েছে বেশ!সেই ১ ঘন্টা যাবত হাঁটছে! যদিও আংগুর গুলো দেখতে কাচা, তাতে কি, খাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে হেসে বললঃ যাও বেশি করে আনো! 

রাতুল হেসে বললঃ এক নাইলা গাছ, উপরে উঠতে পারবো না! তোকে নিচে থেকে কুড়িয়ে দেই, খা! 

রাতুল কয়েকটা নিচে থেকে কুড়িয়ে বাবলুর হাতে দিলো, পাশেই একটা ছোটখাটো বিল ছিল, বাবলু সেখান থেকে ফলগুলি হাতে নিয়ে ধুয়ে একসাথে ৩ টা মুখে দিয়েই চিবাতে গেছে সারা মুখ তিতায় বিষাক্ত হয়ে উঠল!! বাবলু সাথে সাথে মুখ থেকে ফেলে, বিল থেকে বেশি করে পানি নিয়ে মুখ পরিস্কার করতে করতে চিল্লাতে লাগলোঃ

 "কি খাওয়াইছ এটা"! আংগুর কি এতো তিতা হয় জীবনে!! বমি আসতাছে আমার!!

রাতুল হেসে অস্থির! সে মুলার মতো দাঁতগুলো বের করে হাসতে হাসতে বললঃ SSC পরিক্ষা দিবি এখনো নিম গাছ আর আংগুর গাছ চিনস না!! এটা নিম!! 

রাতুলের কথায় বাবলু থ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল!!! বোকা এতোটা আগে লাগেনি নিজেকে!!!





No comments:

Post a Comment